চৌগাছার অবস্থান ও আয়তনঃ-নীল বিদ্রোহের পটভূমি ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রবেশদ্বার চৌগাছা। যশোর জেলার অন্যতম উপজেলা। যার পূর্বদিকে যশোর সদর উপজেলা। দক্ষিণ কোনে ভারতের চবিবশ পর্গনা জেলা, উত্তরে ঝিনাইদহ জেলার কোঁটচাঁদপুর উপজেলা, দক্ষিণে ঝিকরগাছা উপজেলা অবস্থিত। চৌগাছার আয়তন ২৬৯.২০ বর্গ কি.মি।
লোকসংখ্যাঃ-(২০১১ সালের আদমশুমারী অনুসারে) ২ লক্ষ ৩১ হাজার ৩'শ ৬৭০ জন।
ঘনত্বঃ-প্রতিবর্গ কি. মি. ৮৫৯ জন। (২০১১ সালের গণনানুযায়ী)।
চৌগাছা জনপদের উৎপত্তিঃ- চৌগাছা একটি প্রাচীনতম জনপদ। ভূ-তত্ত্ববিদদের অনুমান আজ থেকে দশ লক্ষ বছর আগে হিমালয়ের শেষ উত্থান হয়েছিল। এই উত্থানের ফলে বাংলাদেশের যে সব অঞ্চল গঠিত ঞয় তার মধ্যে যশোরের চৌগাছা। প্রায় পঁচিশ হাধজার বছর পূর্বে গঙ্গা নদীর পলি দিয়ে এভাগের সৃষ্টি হয়। গঙ্গা নদীর পলি মাটিতে যশোর ভূখন্ডের যে সব দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছিল তার মধ্যে চক্রদ্বীপ বা চাকদাহ, এড়োদাহ ও এড়োদ্বীপ, ক্রদ্বীপ, বৃদ্ধদ্বীপ ও সূর্যদ্বীপ অন্যতম। প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে যশোরসহ সমগ্র বঙ্গাদেশ একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম পাদে যশোর তথা চৌগাছা অঞ্চল স্বাধীনভাবে শাসন করেন। হযরত উলুখ খাজা খান জাহান আলী (রাঃ) পরবর্তীতে দিল্লীর সম্রাটগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা এ অঞ্চল শাসিত হয়। সম্রাট আকবরই প্রথম যশোরের ফৌজদার নিযুক্ত হয়। যশোরের প্রথম ফৌজদার হয়ে আসেন ইনায়েত খাঁ। ১৫৭৪ সালে শ্রী হরি যশোর অঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। স্বাধীন ভাবে এ অঞ্চল পরিচালনা করেন।
তারপর খর্খর বেগে ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় চলতে থাকে যশোর তথা চৌগাছায় পথ। ১৫৮৬ খ্রী: শ্রী হরি মৃত্যুর মুখে পতিত হলে ১৫৮৭ শ্রী: তার পুত্র প্রজাপাদিত্য রাজা হন। তারপর পথ পরিক্রমায় মোঘল ও নগরের হাত ঘুরে জনপদের নিঃশর্ত মালিকানা অষ্টাদশ শতকের ষাটের দশকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে যায়। ইংরেজদের হাতে অত্যাচারিত যশোরের চৌগাছা চলতে থাকে। বিদ্রোহী বারুদ পিন্ডবহ্মে ধারণ করে। তারপর শুরু হয় ইতিহাসের নবতর প্লট যার বর্ণনা নীল বিদ্রোহে চৌগাছা অংশ দেখলেই বোঝা যাবে।
চৌগাছার নামকরণঃ-
চৌগাছা শব্দের শাব্দিক অর্থঃ-চৌশব্দের অর্থ চার আর গাছা শব্দের অর্থ গাছ। অর্থাৎ চারগাছের সমাহার চৌগাছা। আবার কেউ কেউ মনে করেন চার রাসত্মার সমাহার চৌগাছা।
ধর্মঃ-চৌগাছা জনপদে মুসলমান, হিন্দু ও খুব অল্প সংখ্যক খৃষ্টান ধর্মের মানুষ দেখা যায়। বৌদ্ধ ধর্মাবলালাম্বী এখানে নেই।
সারাদেশের মতন সাম্প্রদায়িকতা এখানে নেই। বহু যুগ যুগ ধরে সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক বিরাজমান। মৃসলমানদের দুটি বৃহৎ দুই উৎসবে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা এ বৃহৎ দুই উৎসবে হিন্দু মাসলমান সবাই একই মিলনমোহনায় মেতে ওঠে আনন্দ আর নব বন্ধনে মিলে এক সাথে উৎসব পালন করে। হিন্দুদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দূর্গাপূজা। এ পূজায় হিন্দু মুসলমান সবাই মালে আলোয় উদ্ধাসিত হয়ে মিলে যায় মহা মিলদিলে। এছাড়া অন্যান্য উৎসবে মিলিত হয় সব ধর্মের মানুষেরা।
হিন্দু ধর্মের প্রভাবঃ-বহু প্রাচীন আমল থেকে সনাতনী ধর্মাবলম্বীর মানুষ এখানে বাস করে আসছে। বিভিন্ন পূজা পার্বনের মধ্য দিয়ে তারা তাদের ধর্ম পালন করে আসছে। প্রায় সবাই ভারতীয় দেব-দেবীর বিশ্বাসী। অনার্য ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠি এ অঞ্চলে ধর্মাবলম্বী হওয়ায় নানা ধরনের কুসংস্কার ও নানা ধরনের পূজার উৎসব বহুদিন ধরে চলে আসছে।
পরবর্তী যুগে আর্যদের আবির্ভাবের ফলে বহুমাত্রিক উন্নততর পূজার পরিবর্তন লক্ষিত হয়। উন্নততর দেশ জাতি গঠনে দেশের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য উন্নত চরিত্র গঠন, নারী জাতির মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য মা দূর্গা সহ বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা অর্চনা লক্ষ্য করা যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, অনার্য যগের পরে দ্রাবিড় ও আর্য সভ্যতার (উচ্চবর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়) আধিপত্য বিসত্মার লক্ষ্য করা যায়। অনার্য ও দ্রাবিড় মিশ্রিত হিন্দু নিম্নবর্ণের শংকর মানুষের অত্যাধিকতা চৌগাছা জনপদ লক্ষ করা যায়।
খৃষ্টপূর্ব ৪০০০ হাজার বছর পূর্বে আর্য জাতির আবির্ভাব ঘটে। এরা উচ্চতর উচ্চ বিলাসী ও উচ্চাভিসানী। এরা পোল্যান্ড থেকে ভারত বর্ষে এসে বসবাস শুরু করে। প্রথমে ভারত বর্ষের সিন্ধু প্রদেশে পরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
ঐতিহাসিকগণ মনে করেন- হিন্দু নামের উৎপত্তি হয় সিন্ধুর বিকৃত নাম থেকে। চৌগাছার উপদ্বীপ ও সেই আর্যদের অধীনে চলে যায় শাসমত্ম তন্ত্রের কঠোর শাসনে গ্রেপ্তার হয় চৌগাছা। হিন্দু জমিদাররা কঠোর হসেত্ম নিম্নবর্ণের মানুষদের শাষন ও পোষন করতে থাকে।
এছাড়া কর্ত্তিক মন্দির কালিতলা, শীতলা তলা ও পঞ্চানন তলাও সে আমলে বিখ্যাত ছিল। এছাড়া ১২৩৫ খ্রী: কাঁদবিলা গ্রামে একটি শিব মন্দির নির্মিত হয়। প্রাচীন কালের আনকার লক্ষী নারায়ন মন্দিরটি এখন বিলুপ্তের পথে।
এছাড়া উপজেলার গুয়াতলী গ্রামের শিব মন্দির, কালী মন্দির, রথখোলা ও চন্ডীমন্ডপ চৌগাছার অন্যতম প্রধান হিন্দুদের লিলানিকেতন। দেবলা খড়িঞ্চা রাঁধা বল্লবজীর মন্দির বাংলা ১১৭২ সালে নদীয়ার ঘোষ পাড়ার বিখ্যাত গুরু বংশ কর্তৃক জমাজমি সহ ঐ বিগ্রহ তদীয় শিষ্য ফকির আউল চাঁদের সাধনার জন্য স্থাপিত হয়। এখনও ভক্তবৃন্দের শুভাশীষ আবির্ভাবে ধন্য হয়ে ওঠে রাঁধা বল্লবজীর মন্দির। এখানকার আর একটা ঐতিহাসিক নিদর্শনীয় মন্দির শ্রী কৃষ্ণ মন্দির।
মন্দিরটি ভগ্ন অবসত্মায় স্বরূপপুর গ্রামে কালের স্বাক্ষী হয়ে আজো কৃষ্ণের বাঁশি বাজায় আর মানুষের মিলনের কথা বলে।
এছাড়া সেই সময়কার হিন্দু জমিদারদের বাসগৃহের ধ্বংশাবশেষ ও প্রাচীন মা স্বরূপপুর গ্রামে পরিলক্ষিত হয়।
চৌগাছায় মুসলিম জনগোষ্ঠির আবির্ভাবঃ-পীর আওলিয়া, ফকির দরবেশদের আগমনে চৌগাছা জনপদ ইসলাম ধর্মের আগমন ঘটে ও মুসলমান জনগোষ্ঠি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অর্য শ্রেণীর ঘাত- প্রতিঘাত, আর্য শ্রেণী কর্তৃক অত্যাচার নির্যাতন বর্ণবৈষ্যমের তিক্ততা থেকে অনার্য ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে স্বপ্নময় ঝর্ণার স্রোত ধারার মতো বৈষম্যহীন, বর্ণহীন, অবর্ননীয় আওলিয়াদের আচরণে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে নিম্ন হিন্দু সম্প্রদায় (আর্যরা) ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হয়।
৬১০ হিজরীতে ১২ জন আওলিয়া আসে। ৮০০ খৃষ্টাব্দে হযরত খানজাহান আলী (রাঃ) প্রথমে এ উপদ্বীপে ইসলামের মহান বার্তা নিয়ে আসেন।
এছাড়া হযরত শাহ সুফি সুলতান আহম্মদ মানসিংহের সাথে পদাতিক বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে অঞ্চলে আসে ও ইসলাম প্রচারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। হযরত শাহ আলী (রা.) এর উত্তর পুরুষ হযরত শাহ হাফিজ অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে চৌগাছা অঞ্চলে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী বারবাজার সেখানে বার আওলিয়ার আবির্ভাব ঘটে। তারা হিন্তু উচ্চবর্ণের বর্নবাদ প্রথায় লাথি মেরে অনার্য শ্রেণীর সঙ্গে সত্যধর্ম ইসলামের মর্মবানী তুলে ধরেন।
সাম্যবাদী বৈষ্ণম্যহীন পবিত্র কুরআনের মর্মবানী মর্মস্পর্শ করার মাধ্যমে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের ‘‘তাওহীদের একত্ববাদ’’ শিক্ষা দেয়। এছাড়া বহু পীর ফকিরের দর্গাতলায় মানুষ মুরিদ হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। পরবর্তীতে ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেব খড়কীর পীর সুফী মুহাম্মদ আঃ করিম (রাঃ), এছাড়া পাঁচ পীরের কথিত লোক কাহিনী শোনা যায়। এছাড়া বলু দেওয়ান (হাজরাখানা) এই আওলিয়া বহু অলৌকিক কাহিনী ঘটিয়ে সেই সময় বহু মানুষের ইসলামের পথে আনতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে মুন্সী মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহ। ইসলামের বিপ্লবী ঝান্ডা আর শক্তিশালী ভাবে তুলে ধরেন।
এছাড়া মাওলানা নিজাম উদ্দীন (বেড়েয়ালী), মাঃ জয়নাল আবেদীন (মাঠচাকলা), তাদের আচার আচরণে ককিল কণ্ঠ ওয়াজ নছিয়তে এলাকার মানুষ ইসলামের দিকে এগিয়ে আসে।
প্রাচীন তম মসজিদ বা উপাসনালয় তেমন দেখা যায় না। তবে উপজেলার হাকিমপুরে রানীভবানীর নির্মিত মসজিদের ভগ্নাংশ পরিলকি্থত হয়। এছাড়া স্বরূপপুরে মুঘল আমলের প্রতিষ্ঠিত মসজিদ বিদ্যমান। যেখানে দুটি পাথর আছে একটিতে কালিমা ও অন্যততে আয়তুল কুরসি লেখা আছে। এই পাথরদ্বয়ের স্পর্শ করা পানি দুধ তৈল রোগের ঔষধ হিসেবে বহুলোক ব্যবহার করে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস