চৌগাছা উপজেলার ভূ-প্রকৃতি ও ভৌগলিক অবস্থান এই উপজেলার মানুষের ভাষা ওসংস্কৃতি গঠনে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এই উপজেলা অবস্থিত। এখানে ভাষার মূল বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের অন্যান্য উপজেলারমতই, তবুও কিছুটা বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন কথ্য ভাষায় মহাপ্রাণধ্বনি অনেকাংশে অনুপস্থিত, অর্থাৎ ভাষা সহজীকরণের প্রবণতা রয়েছে। ভাষার অনেকটাই সাযুজ্য রয়েছে। চৌগাছার জনসাধারনের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
চৌগাছার প্রাচীণতম লোকগীতি ‘‘ফলই’’
অস্বাভাবিক সৃষ্টিধর্মী আর সুষমা শব্দ ছন্দ ব্যঞ্জনার প্রাচীণতম লোকগীতি ‘‘ফলই’’ চৌগাছার গ্রামাঞ্চলকে এক সময় মুগ্ধ করে রাখতো। দল বেঁধে বাড়ী বাড়ী গিয়ে প্রচলিত সমাজের বিভিন্ন ঘটনাপুঞ্জ গানে গানে কথার শব্দাবলীতে তুলে ধরতো আর সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনতো অশ্রু ফেলতো। এ যেন হোমারের ‘‘এডিসি’’ নায়ক ওডিসিয়ূর বর্নন। যেমন মাকে পিঠা তৈরী করতে বলেছে বলে জৈষ্ঠ্য মাসে মাঠে বিদা দিতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ দুপুরে হিরণ মারা গেছে। মায়ের কান্নায় ধ্বনিত ফলই-
‘‘ ওরে সোনা খোকা আমার হিরারও হিরণ,
মাঠে গিইয়া কেন তোরে হইলোরে মরণ,
আমি পিঠা রাইন্দা, গামছা বাইন্দা
কেবলি যাচ্ছিলাম মাঠে
খবর কেন দিল লোকে হিরণ মরণ ঘাটে।
গুড়গুড়ার পাকান পিঠা এককানও না খালি
অকারণ আমি তোরে দিলাম কেন গালি
সারা জীবন ওই পিঠা আমি খাবো নারে
তুই থাক সোনা আমার
আমি যাই ওই গোরে।
যেমন আরজুল্লারা নয় ভাই নয় রকম কাজে ব্যসত্ম থাকে। এ নিয়ে প্রচলিত ফলই এরকম-
মিয়া ভাই আরজুল্লা হুক্কা হুকা টানে
খোকর খোকর কাশি মারে টাকুরে কুষ্ঠা বোনে,
বউ তার ঝগড়া ঝাটির একখানা ওসত্মাদ
কথায় কথায় খোটা দেয়, জাত ও বেজাত।
মেজে ভাই রাহাতুল্লা জাল নিয়ে যাই বিলে
জালের মাছে খলই পোরে না নিয়ে যাই চিলে।
হাদা ধরে ধরে খাই সে, কাঁদার মদ্দি পুতে
চার জিয়েলের হিন্দোনে ফেলে সে যেত মুতে।
সেজে ভাই পাল্লা আল্লা আল্লা করে।
পাঁচ পীরের দর্গায় ছিন্নি বিলেতন করে।
হাটুর উপর ফোড়া হলে পরজ তরক করে
বুড়ি গঙ্গা পার হইতে কাপড় হাতে করে।
নোয়া ভাই ন’মিয়া চালায় ঘোড়ার গাড়ি
নয়া বউ পেলে সাথে বিদেশ দেয় পাড়ি।
সোয়ারি লাবিয়ে এসে ঘোড়ার ভাবে বউ
সাত পরী চাননী রাতে খেলে যাইরে ঢেউ
ত’ মিয়া তজিবুল্লা খেজুর গাছ কাটে
আগলা পাছায় হেইচা টানে গাছের কাটা ছাটে
বাড়ি এলে উলা গুড় বউ দিয়ে জ্বালায়
এদিক ওদিক ঘুইরা ফিরইরা শোয়
ছকিনার চালায়।
লাল পয়সা থুয়ে দিত মাটির ঘরের হাড়ায়
হাটে গিয়েছে জিবুল্লা আর বউ রয়েছে পাড়ায়
এই সুযোগে জিবুল্লার বাঁশের দরজা খুলে
শ্যামচোর নিয়ে গেল মাটির হাড়া তুলে।
আট নম্বর নাম ছিল নাম নাহি আর পাই
বাড়ী বাড়ী ঘুরি আমরা ‘‘ফলই’’ গেয়ে যাই।
পাঁচ সেরের কম কেউ চাল দিয়না বাসত্মায়
ডাববা হুকায় নেশা মারবো গিয়ে বড় রাসত্মায়।
দশ সের মসুরী দুবা দশ সের ছুলা
তবেই এই গায়েনদের পুরে যাবে ঝুলা।
আট নম্বরের ছিল শোন তিনটি মোটা বউ
সারাক্ষণে সব কাজে লেগে লাকতো ফেউ
বড় বউ দুধেল ছিল কুমড়ার মত দুধ
গায়ের অনেক বউ ঝিয়েরা দু’য়ে খেত ঔষধ।
কুমড়ো হুমরো হল তার চার চারটি মেয়ে
হেড়ে কালি লেপট মাখা, বারপেনে চেয়ে।
জামায় হলানা কার মদ্দা হিজলের মত
দগ্ধ করে গা গেরাম মাঠ ঘাট কত।
মেজে বউ চিকন চাকান চন্দ্রকুলি নাক
তার ছিল পেরা মেতে ভা ভাতারের ঝাক
বারান্দায় শুয়ে থাকে চাঁনের আলো ঢোকে।
চুরি করে ডাববা হুকায় দোমে দোমে ফোকে
ছোট বউ কুট কুটিনা কানে কথা লাগায়
ঝগড়া ঝাটি টেনে আনে, কাঠাল সিদ্ধ মাখায়।
তিন বউ তিন বারান্দায় শুয়ে থাকে রাতে
আট নম্বরের সব সময় থাকে নড়ি হাতে।
নয় নম্বরের কথা কব ওসত্মাদ করিম দাদা
দম মেরে নেই দাড়া আটুট, ধরিয়ে নিই হাদা।
চাল ছুলা মুসরি দেও বাড়ীর কর্তা গণ
আর ফলই শুনাবো পরে দেও এদিক মন।
চারিদিকে চাননি রাত আলো থৈ থৈ করে
এমনি রাতে ফলই গাইতে মন প্রাণ ভরে।
বাড়ি রেখে আইছি মোরা সোনার আলো বউ
মনে প্রাণে আনচান খেলতে আছে ঢেউ।
নয় নম্বর বেটার কথা এবার করি শুরু
সাম মাকড়া শ্যামকলু গাইনে সবার গুরু।
নলে কলু কথায় কথায় মারে কথার বান
শুকিয়ে যায় দিল কলজে কাটে হাটু ঠ্যাং।
নয় নম্বর ছিল একটু রাত কানা লোক
বিয়া করার ওসত্মাদ সে যে নতুন শাওড়ির ঝোঁক।
একশ খানিক বিয়া করছে একশ রকম মায়া
ছেলে পিলে পাঠিয়ে দেয় নেই মনে মায়া।
কত ছেলে কত মেয়ে নেই হিসাব তার
দুই একটা পুলা হাইলে করে না আর পার।
শ্বশুর বাড়ীর পয়সা নিয়া শ্বশুর বাড়ী যাই
নতুন নতুন নলিনি গুড়ে ভোমর যেমন গায়।
লজ্জা সরম নেই তার যে টাটকা মুখের কথা
রসের ভাড়কথার মধ্যি পাবে যথা তথা।
বেদে পাটি পেতে দিলে পেদে দিয়ে ওঠে,
একশ’ একটা শাওড়ি বাড়ী, হুশ নাহি ওঠে।
লগত কথা লগত কাজ, নয় নম্বর নাম
রাত হইলে আম কাঠাল চুরি করা কাম।
চাননি রাতে ভাড় ভাড় চুরি করে রস
আটালিতে পাটালি বানাই সেইতো মনের আশ।
মাঠ থেকে চুরি করে ছুলা মুসরি আনে
চাননি রাতে বউ নিয়ে সে মাতে বাঁশির বানে।
কোন দিন রতন গায়ের নলিডুগরির বিলে
ভরা পুকর রাত দুফরে মাছ মারে জালে।
তেওড়া গুড়া মূলা হুড়া আর রসের ভাড়
ভোর পমত্ম নেশা করে হুকায় কলকে নাড়।
নয়া বউ থাকে সাথে রাতি দিনি ভরি
নয় নম্বর রাতির হায়না এ জীবন ভরি।
অপরূপ রসাভ নিজেল গায়ের কন্ঠরনে ধ্বনিত এসব ফলই বাংলা সাহিত্যের বিরাট সম্ভাবনার লাইব্রেরী এসব শুনলে গায়ের নিটোল গন্ধ পাওয়া যায়। ছন্দের সুরঞ্জনা আর সাহিত্যের বিরাট মহাকাব্য না হলেও প্রাচীণ বাংলার ইতিহাস আর ঐতিহ্য ভরপুর রসাভ গীত সংগ্রহের একামত্ম প্রয়োজন। শুধু রসের ভান্ডার নয়, প্রকৃতির রূপ রস, হাসি কান্না বিরহ মিলনের মিলমোহ এসব ‘‘ফলই’’।
ছয় মাসের ঋতু বৈচিত্রের বিরল বর্ণনা রয়েছে এসব ফলই গীতেঃ-
‘‘আম থল থল আম থল থল
আইলো বোশেখ মাস
সবুজ পাতায় কাঠাল পাকায়
আনন্দের নিশ্বাস
আহ্ আনন্দের আশ্বাস।
নাভাঢা ধানের মেঠো গানের
উননে নলিনী বউ
কুষ্ঠা পাতার নরম শাকের
ওঠে নতুন ঢেউ।
শুমরাল গাছের হলুদ ফুঁলে
চুল বেঁধে যাই মেয়ে।
ককিল কুয়ো ধরে ধূয়ো
পাতার ফাঁকে চেয়ে।
গুটি আমের ঝালায় করা
শিশোনো ঝাল খেয়ে
খিল খিলিয়ে হাসে কিশোর
পানি ঝরে গাল বেয়ে
আহ্ পানি ঝরে গাল বেয়ে।
ধান বোনে মাঠের চাষি
আগলা তেথোড় কাছা
হুকা টানে মাঠের গানে
গরমে দায় বাঁচা।
আহ্ গরমে দায় বাঁচা।
খাল বিলে ফাটাফাটা
পাকাল মাছের ঠোট
কাদা পানি খাই চুষে
যেন দুধেল বোট
আহ যেন দুধের বোট।
আম পাকিছে, জাম পাকিয়ে, পাকিছে আহ গাছের কাঠাল
ক্ষীর কাঠালের মজা মজা গন্ধ উড়া গাল
আতা পাকিছে লেওয়া পাকিছে, মাঠ ভরা কচি চারা
বিদে বাসই দিতে চাষী ব্যসত্ম আছে তারা।
ভেতে মাক শুলার শাক, মূলার মজা হুড়া
তালের কোষের নরম রয়ে মন প্রাণ জুড়া
বড় গাঙের কালো পানি ঠান্ডা মনের মত
স্যান করতি ছেলে মেয়ে মাছ ধরে যায় কত
গমের রুটি পাতলা গুড় কিসে মজা লাগে
মনের মাঝে পাতার বাশি কি প্রীতি জাগে
জৈষ্ঠ্য পাকা খেজুর খাই কষে ছেলে বিলে কুকুর
আম শীতল পানি শীতল আর শীতল বউ
ডাববা হুকায় টান মেরেনে, করিসনে খেও খেও।
আষাঢ় মাসে কষাড় নামে বউ নামে স্যানে
চাঁদের মত ডুব খেলে যাই দুই হাত দেয় কানে।
হাতে বাজে নয়া বইয়ের গাদাগাদা চুড়ি
নানা রকম মেঘরা নেমে বাজায় শঙ্ক কড়ি
ঝিয়া পুটি ভেসে ওঠে যায় ঝাকে ঝাকে
ছেলে বিলে খেলা করে মেঘপানির সনে
শালিক ছানা পাখনা মেলে খেজুর গাছের কোনে
আটি ভাজা ছুলা ভাজা ঘরেতে নেই ভাত
(চুলা) আখাই শুধু ধুমা ওড়ে গিন্নির মাথায় হাত।
শ্রাবণে অভাব এল ঘরেতে নেই খাবার
উনমনে ভূড়ার চালে ক্ষীর রেন্দে দে আবার।
আউশ ধানের দুধ সর সর উনসিয়ে কড়াই মাছে
ফেনা ভাতের জন্য ওরে
হন্য গিন্নি কাজে।
ঘরেতে ছোট বিলে করে হাও মাও
দুধ নেই মায়ের বুকে কান্দে শিশু কেও কেও।
বিল ডুবা খাল ডুবা ধান পাট গেল তলিয়ে
মাছে গাদা, সরপুটি দাদা খেলয় ভরে যাই নিয়ে
মাছ চ্চচড়ি করে দাদী সরশো বাটা ঝালে
তাই খেয়ে ইদর আলী আবার যাই খালে।
অভাবে অভাবে শ্রাবণ নলে কলুর গান
পাতিবিলের জয়নাল কবি ছন্দে মারে টান।
ভাদরেতে ভরে গেছে খাল বিলা নদী
ধান পাটের অভাব নেই মাঠে চাও যদি
ওরে আদরও বেড়ে গেছে বাড়ীর বউ ঝিয়ের
নলিনী ভাতের গন্ধে ভরে গেছে গায়ের
গাই গরুর দুধ আর আইশ ধানের ভাত
দুধচাপা কলার সাথে, শুরু সবে বরাজ।
সাদা সাদা রুটি আর কুকড়ো হেলা আছে
চাননি রাতে দারুন মজা পিটে গড়ার কাজে।
খালা বিলা জুড়ে আছে হরেক রকোম মাছ
পাবদা পুটি কৈ মাগুর খেয়ে সবাই নাচ।
গাদি খেলা কানা মাছি চুবুড়ি খেলা
রাতি বলে গা জুড়ে হরেক রকোম মেলা।
‘‘ফলই’’ গাইতি রাতি আছি ফলই মাছা আর কলই
এমন সুন্দর মাস আর নাহি আসে হেতা
দুশ গাইনের শুতে দুবা, দশটা নকশি খেতা।
আশ্বিনে ঢল নামিলো নামিলো রে ঢল
মাটির বাড়ি খসে পড়ে গাঙদেওয়াড়ের পর।
পানি পানি করে কান্দে খোকা খুকু ঘরে
দামড়া গরুর চামড়া ওঠে দেওয়াল চাপায় মরে।
আমন ধান তলিয়ে গেলে বিলে নেই ঠেই
চাষিরা মাচার পরে বিচেলী কাটে খেসেয়
হেসেলে হেসেলে দুমা খড়ি যাই লিভে
পাটকাটি ফুর্দিতে ধুমপুড়া হয় জিভে।
খেচুড়ি ভাত পুড়া ঝাল সাথে পুটির ঝোল।
দুফরটা কাটে ভাল রাতে আল্লা বোল।
বৃষ্টি ফোটা থামে নারে আকাশ ফুটা নাকি
মেঘ রাজারা আকাশ থেকে দেয় শুধু ঝাঁকি
মাঠে মাঠে বেড়ায় চাষি আগলা পায়ে জোক
কই মাছের ঝাঁক চলে যাই চারর মধ্যি ঢোক।
বৃষ্টি বেলা থেমে যাই আশ্বিন মাসের শেষে
দু’’খ কষ্ট নেমে যাই সুখ আবার আসে।
কার্তিকের বাতিক দেখি সারা গঞ্জ গাঁয়,
জলপানিতে আমন থৈড় বিলে উছলায়,
কুয়ো পড়ে শীত শীতা কলই গন্ধ গানে
কেলে ধানের বান নামিলো সোনালীদের টানে
চকচকা গাঙ দেয়াড় মাছের নানা খেলা
চ্চচড়ি মাছ ফেলে দে রে, সরপুটি কৈ মেলা
জিয়েল শৈল, ভরা আপায় ছেওচ দিয়ে ছেচি
কুলার মধ্যি মাঝ জিয়ো, কার কাছে মাছ বেঁচি
সুলার ডাল শৈর মাছ ভারি মজার খাবার।
এক দোমে হুকায় কল্কে তামুক সব সাবাড়
গাছে গাছে বেল ভরা তেল ভরা তিলে
মাছে মাছে গাঙ ভরা, মাছ নিয়ে যাই চিলে
কুজ বক, দাড় বক, কাদা খোচার ঝাঁক
সারা দিন ব্যসত্ম কাজে, ধরে মাছের ঝাঁক।
অগ্রায়নে ধানে, ধান গান গান মাঠ
আমন ধানের গন্ধে নলিনী গন্ধ বাতাসে মিশাল
চারিদিকে আনন্দ চাষিদের বিশাল
গঠন গরু খাই কাচান মাচান ভরা চাষির
বউ ঝিরা কম্মে ব্যসত্ম পামত্মাভাত পরশির
খোন আমানি তাতে পিয়েজ পুড়া ঝাল
পাকাল মাছ আর শৈর চ্যাঙ মাছে ভরে যাই গাল।
রঙিন গামগায় নতুন চিড়া কড়মড়িয়ে খাও
গাড়ের কান্দায় চাননি রাতে ফলই বেন্দে যাও
পিঠা আটা কুড়ি পিঠা কাঠাল পাঠায় পিঠা
কুকড়ো রান্দা হেমেলেদে, দারুন লাগে মিঠা
সন্ধে হলি ছেলে মেয়ে গাড়ি খেলায় মাতে
বকুল ফুল ভোরে কুড়িয়ে সুতই মালা গাথে
ভোর না হতে বউ ঝিয়েরা ঢেকিই ধান কোটে
বেলা না উঠতি উঠতি কাড়ায় চাল নোটে
সাথে আছে বুড়ো দাদী পান খেয়ে গায় গান
বেলা না উঠতি বউরা করে গাঙে স্ন্যান
শীত শীত করে ওই এসে গেল পৌষ
বুড়ো বুড়ি হুঙ্কা টানে করে ফোস ফোস।
গাছে গাছে গাছিরা কাটে খেজুর রস
ভাড়ের নাড়ে শব্দ ঝরে, নলিনি গন্ধ বাড়ায়
নাড়ার আগুনে সন্ধ্যে কালে পুহায় সবাই আগুন
উলা গুড়ের মলা ঝোলে বাড়ায় মজা দ্বিগুণ
সন্ধ্যে রসের দারুন মজা গাছে গাছে উঠি
বছর বছর তৈরী হয় গাছের উঠার খুটি।
পাটালি আর গুড়োর লেদি কিসে মজা লাগে
রাত্রি কালে রস পায়েশে দারুন নেশা লাগে
হুঙ্কার হোকার টানে টনকো বুড়ো আবুল
হাসি মারে কাশি মারে, বউ গালে দেয় গুল।
পাকড়ার তুলায় লেপ বান্ধ্যা শীতে আরাম হয়
নতুন গয়না পরা বিবি যদি পাশে রয়।
এই শীতি মজা লাগে গরম গরম ফলই
হাসি কথার পুটলি বান্ধা একশ রঙের সই
রঙিলা রঙের শীতে কাঁপে কাঁপন বুড়ো
বাবলার জ্বাল দিয়ে তারে একটু খানি জুড়ো।
বাঘেরও কাপনি নিয়ে এলরে ওই মাঘ
বত্রিশ ভাড় রস নিয়ে রাজ্জাক ভাঙে বাক
এক চিকে বান দো চিকে বান চৌদ্দ চিকে বানে
রস জালায় টোঙর ফকির, ফিকির বাজে গানে,
ঝোপের মাঝে দাড়ি গোপে খোকর মারে হুকা
কাশির কোপে পালায় দুরে মশা মাছি পোকা
বরফে ঢাকা থাকে বুঙিগাঙ বড় গাঙ
ঝাঁপটি মেরে থাকে পটে, কৈ, শৈল আর চ্যাঙ
লেপ খেতায় যাইনারে ছোবল মারে শীতি
এই রাতে আক্কাস বুড়ো পড়ে কালু গাজির পুতি।
হাড়ে হাড়ে বাড় দেয়া রহিম গাজির দেহ
হুকোর দমে বেঁচে থাকে জানে না তা কেহ
চুন্টোবুড়ো চুন তামুকে করে হরেক নেশা
চাননি রাতে গাঙ দেয়াড়ে মাছ মারা পেশা।
সারারাত না ঘুমিয়ে বক বকানি বকে
আনোর বিশ্বেস ভোর বেলায় জুমায় আজান হাকে
কানের মদ্দি আঙুল দিয়ে ভোরের আজান দেয়
আল্লা আল্লা জিকির করে শীত দুরে পালায়।
ফালগুনে শীত গেল এল কুসুম মাস
গাছ গুলো হাই ছাড়ে, আমের বৈল উল্লাস।
আম জাম কাঠাল গাছে নতুন ফলের কুড়ি
শাক তুলতে যাই মাঠে গায়ের ছুড়ি বুড়ি।
ককিল ডাকে কুহুকুহু কুকো ডাকে কুক কুক
মুসরি ছোলা আসে খামারে, ফর্সা চুক চুক।
নতুন মুসরির ডালের হলুদ খেচড়ি রান্না
ঝাল পিয়াজে ভরা সেথা, খেতে লাগে কান্না।
পাকড়া গাছে পাকড়া ফোটে সজনে গাছে হাসি
খাতি মজা পামত্মা ভাত, কড়কড়ে কিবা বাসি।
বসমেত্মর গুটি ওঠে গ্রাম গ্রামে গাদা
সাত পাচনে ওষুধ দেয় হিয়া কবিরাজ দাদা।
গোপে দাড়ি ভরা কবিরাজ চায় চাল কুমড়ো
সোনার পানি কলসি ভরা আচ্ছা ছিদন বুড়ো।
ফু-ফা দিয়ে তাড়ায় বিকার মুনসি পীর যত আছে
সরা বান্দে বাশের আগায় যদি গ্রাম বাঁচে।
নরম কলার পাতায় শোয় বসমেত্মর রুগি
দুই দিন খাওয়া বন্ধ পানি পড়ার যোগি।
খাল বিলে নেই পানি কাদায় পাকাল মাছ
উকোস কাটে গর্তে জিয়েল ধুড়ায় ধরে নাচ।
গরুর বাছুর ছেড়ে দিয়া খোলা মাঠের বিলে
চিতল চর আর ঢিবের খামে ফোঁস দিয়ে খাই তালে।
গাঙ পার করে রাখাল ওই পারে যাই নিয়ে
ছোট বাছুর করে পার এ্যাড়ের লেজ বাধিয়ে।
খোলা গাড়ি পার করে তেজি দামড়া দিয়ে
পানির মধ্যি সাতার কাটে উলটো দোম নিয়ে।
পট কাটে ঘাস কাটে কাটে বিলের নাড়া
গরুর গাড়ি বুঝায় আনে কৃষকের সন্ধ্যেয় তাড়া।
চৈত্র মাসে চতে বাজার হরেক রঙের হাড়ি
মাটির পুতুল কলস আর কলকে আনে বাড়ি।
জিলোপি রসগলা পান তুয়া বন্দেল ভাজা
আম খাওয়া ছুরি, গুলতি কিনা, পিয়াজী লাগে মজা
হলুদ ফিতা কুমকুম আর পাওটার কাচের চুড়ি
বাশের বাশি কেনে আনে বটগাছে, রঙের হরি।
বুড়ি বট তলায় মিষ্টি দেয়, হরির পুজা করে
মুসলমান হিন্দু এক হয়ে আনন্দ ফূর্তি করে।
বিয়ে বাড়ীর ফলই
বর এয়েছে পাকড়ি পরে
মুকি রুমাল দিয়ে
ঘোড়ার গাড়ির বর যাত্রি
রাতি হবে বিয়ে।
কন্যার বয়স নয় বছর
ভয়তে কাপে দিল
চল্লিশ বছর বরের বয়স
পাঞ্জাবি ঝিল মিল।
এক বিয়ে দো বিয়ে
তিন বিয়ের পালা
বরের সাথে বর যাত্রী
বদমায়েশ সব শালা।
বউ সাজিছে চোখের পানি
ঝরঝরিয়ে ঝরে।
বাসর রাতি যাবার আগে
কেন্দে বউ মরে।
বাপে মায়ে চিমত্মা করে
দুই সতিনের ঘর
কেমন করে মেয়ে আমার
হয়ে যাবে পর।
হলুদ বাটে মিন্দি বাটে
হলুদ চাননি রাতি
বর বউ গোসল সেরে
ক্ষির দেয় খাতি।
খাতি দেয় সরু পিটের খীর
সাথে পাকান পিঠে
বিয়ের বাড়ি পান খাতি
লাগে বড় মিঠে।
কাঁদা খেড়ে দাদা দাদী
ছেছড় খেয়ে খেয়ে
হাসির তুফান উঠতি থাকে
পাড়ার বউ ঝিয়ে।
পরদিন কন্যা চলে যাবে
ঘোড়ার গাড়ি করে,
খই মুড়কি মিষ্টির হাড়ি
গাড়ি দেয় ভরে।
গরুর গোশত খাসির গোশত
ভূড়ি কাল্লা খেয়ে
গাড়ি ওঠে বর যাত্রী
বিয়ের গান গেয়ে।
যখন কন্যা যাই চলে
মর কান্না পড়ে
চল্লিশিকা বর তখন
লম্বা দাড়ি নাড়ে
হাসতি হাসতি পান খেয়ে
বউ নিয়ে যাই
নয় বছরের বউ শুধু
করে হাই হাই।
শাউড়ির বকনি ননদের বকনি
সতিনের উৎপাত
কান্নায় ভাঙে নয়া বউ
খাইনাতো ভাত।
কি দেলে আর কি দেলে না
এই নিয়ে কথা
নয়া বউয়ের মনের মাঝে
জাগে বড় ব্যথা। যেসব সরকারী সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা চৌগাছায় কাজ করছে।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে চৌগাছা উনিশ শতক থেকে নাটক ও যাত্রায় বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। নাট্যকর ও যাত্রা লেখকও রেয়েছে এ জনপদে। তাদের মধ্যেঃ-
আজিজুর রহমান (প্রাক্তন চেয়ারম্যান, হাকিমপুর ইউপি)
ডাঃ মোঃ সিরাজুল ইসলাম (ইছাপুর, সাহিত্যত্ম)
বি, এম হাবিব (প্রাক্তন চেয়ারম্যান, চৌগাছা)
দাউদ বি: (বিশ্বাসপাড়া)
মরহুম আজিজুর রহমান (সাবেক চেয়ারম্যান, চৌগাছা)
মরহুম শাহাবুদ্দীন মল্লিক (বাঁদেখানপুর)
তোফাজ্জেল হোসেন (টেঙ্গুরপুর)
আঃ লতিফ বিশ্বাস (বিশ্বাসপাড়া)
আমির হোসেন (বাড়ীয়ালী)
শফিউদ্দীন (আলিয়া যদুনাথপুর)
রেজাউল (বেড়গোবিন্দপুর)
আশরাফ হোসেন আশা (সাবেক চেয়ারম্যান, সিংহঝুলী ইউপি)
আহাদ আলী (চৌগাছা)
নিমায় (চৌগাছা)
দেবাশিষ মিশ্র জয় (চৌগাছা)
আনিস (মাজালী)
মজনু (মাজালী)
কালু (জগদীশপুর)
হায়দার (জগদীশপুর)
মুকুল (পুড়াহুদা)
প্রভাষক জাহিদুর রহমান বকুল (চৌগাছা ডিগ্রী কলেজ)
মোহাম্মদ আলী মুর্শিদী (দিঘলসিংহা)
ডাঃ মিরাজুল ইসলাম (ইছাপুর)
শিল্পী আতিয়ার রহমান (বিশ্বাসপাড়া)
মনিকা মিশ্র জলি (চৌগাছা)
ডাঃ আঃ জলির (আশার পিতা, জগন্নাথপুর)
আনিছুর/ আশিকুর (জগন্নাথপুর)
মাসুদ, আবু সাইদ, শরীফ (যাত্রাপুর)
মুকুট, দসত্মগীর, ইমাদুদুল হক (জগদীশপুর)
আইকন (পনি) (চৌগাছা)
জলি (চৌগাছা)
আঃ মজিদ (যাত্রাপুর)
আমির হোসেন (বাড়িয়ালী)
নজরুল ইসলাম (হাকিমপুর)
মশলেম (চৌগাছা বিশ্বাস পাড়া)
কবি শাহীন মাহবুব (দেবীপুর)
এছাড়া গ্রামে গ্রামে অজস্র সাংস্কৃতিকর্মী সাংস্কৃতি চ্চর্চা করে যাচ্ছে কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সাংস্কৃতি সম্পর্কে বলেছেন- ‘‘নিভৃত পল্লীতে ছোট নদীর ধারে যদি কেউ শঙ্ক নাড়ায় আর গান গায়, যদি কেউ বাশের বাঁশি বাজায় নিজেই শোনে, সেই বাঁশির সুর, তবে সেটায় তার সাংস্কৃতি।
সংগীত শিল্পীঃ-আলী রমজান রুমি, অপু চৌধুরী, শফি, ফারজানা ববি, নজরুল ইসলাম, মতিয়ার রহমান, বিকাশ কুমার, শেখ মাফিজুল ইসলাম উল্লেখযোগ্য
ক্লাব ও সাংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানঃ- ক্লাব ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সাংষ্কৃতির মিলনের মোহনা। সৃষ্টির প্রতি প্রভা শুরু সূর্য। উল্লেখ যোগ্য ক্লাব ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সমূহের নাম বর্ণনা করার মতো-
কপোতাক্ষ সাংস্কৃতি গোষ্ঠী,
মহাকাশ সাহিত্য পরিষদ (দেবীনগরী)
সুর সংঘ ক্লাব, গ্রগতি সংঘ,
কিশোর ক্লাব, অনির্বান,
চৌগাছা গণ গ্রন্থাগার (পাঠাগার)
বাড়িয়ালী পাঠাগার (নাসির হেলালের উদ্যোগে)
কবি আহমদ আলী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (কয়ারপাড়া)
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংঘ,
আপন নাট্য গোষ্ঠী,
ফ্রেন্ডশীপ ফ্যামিলি,
তীর্ষক নাট্য গোষ্ঠী,
শেকড় নাট্য গোষ্ঠী,
কিশোর সংগীত একাডেমী,
সোনালী সংঘ (হাকিমপুর)
হাকিমপুর গণকেন্দ্র পাঠাগার,
অর্পন দর্পন পাঠাগার, মুক্তারপুর।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস